“মংপু – ফিরে দেখা!”

“মংপু – ফিরে দেখা!”

[ ভূমিকা – দার্জিলিং জেলার কার্সিয়াং সাবডিভিশনে, পাহাড়ের কোলে ছোট্ট মংপু (Mungpoo বা Mongpu) গ্রামটি বাংলা সাহিত্যে যে স্থায়ী আসন লাভ করেছে, তার প্রধান কারণ মৈত্রেয়ী দেবী। স্নেহধন্যা মৈত্রেয়ীর আমন্ত্রণে এইখানেই একটি সুদৃশ্য বাংলোতে রবীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে চারবার এসেছিলেন। সেই সময়ের অনবদ্য স্মৃতি আমরা পাই ‘মংপু-তে রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে। তবে আমরা অনেকেই জানি না, ১৮৬৪ সাল থেকে এই মংপুতেই চাষ হত সিনকোনা (Cinchona) গাছ, যা থেকে তৈরি হত প্রাণঘাতী ম্যালেরিয়ার অব্যর্থ ওষুধ কুইনিন। খানিকটা এই কুইনিন আবিষ্কারের ফলেই ভারত ও আফ্রিকার ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে, অসুখের ভয় কাটিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশক শক্তি সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পেরেছিল।
লেখকের বাবা, ডঃ মনমোহন সেন জীবনের প্রথমে মংপুর কুইনিন ফ্যাক্টরি ও রিসার্চ সেন্টারের প্রধান হয়ে গিয়েছিলেন। কাজে যোগ দেবার পাঁচ বছর পরে বিয়ে করেছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীকে। মংপুর মতো দুর্গম জায়গায় চাকরি না নিলে, আমরা মংপুতে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পেতাম না।]

বিয়ের পর নতুন বউয়ের প্রথম দিন শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় আশা, আশঙ্কা, আনন্দ মিলে মনে যে অভূতপূর্ব অনুভূতি হয়, ছেলেদের চাকরি তে যোগ দেবার প্রথম দিনের মনোভাবও হয়ত বা অনেকটা সেই একই রকম। দুই ক্ষেত্রেই জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু। এক অজানা জগতে প্রবেশ।

যারা নতুন চাকরিতে যোগ দিতে যাচ্ছেন তাদের কারো কারো জীবনে ঘটনাচক্রে সত্যি সত্যিই কিন্তু এই দিনটি বিশেষ ভাবে মনে রাখার মতো হয়ে থেকে যায়। আমার বাবারও কাজে যোগ দিতে যাবার প্রথম দিনটি ভোলবার মত ছিল না। ছোটবেলা থেকে সেই রোমাঞ্চকর কাহিনী মায়ের মুখে শুনে এসেছি।

আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর আগে, ১৯২৯ সালে এক শীতের সকালে, প্রথম বার কাজে যোগ দিতে যাবার পথে আমার বাবার যে রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছিল – সেই ঘটনার কথা লিখে রাখব বলেই আজ কলম হাতে নেওয়া। আমার বাবার স্কুল জীবনটা কাটে ব্রহ্মপুরে যাকে আজ আমরা সবাই বহরমপুর বলেই জানি।

বাবা মেধাবী ছাত্র ছিলেন, বরাবর ক্লাসে প্রথম হতেন। দু দু’বার ডাবল প্রমোশন পেয়ে ছিলেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হল। বিফোর টাইম মেল ট্রেন আসলে যেমন হাওড়ার স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়, আমার বাবাকেও তেমনি বিফোর টাইম এন্ট্রান্স পরীক্ষার দোরগোড়ায় এসে দুবছর অপেক্ষা করতে হয়। তখন নিয়ম ছিল ষোলো বছর বয়স না হলে পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না। মানুষ যে কতভাবে কত নিয়মের জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে তার শেষ নেই। M.Sc পাশ করার পর বাবা প্রণম্য বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নির্দেশনায় ডক্টরেট করেন।

দুঃখের বিষয়, ঠিক এই সময়েই আমার ঠাকুর্দা, ক্ষেত্রমোহন সেন, প্যারালিটিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণ ভাবে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, বাবা নিজের জন্য কখনোই খুব একটা ভাবতেন না। নিজেকে সরিয়ে রেখে নীরবে অন্যের সুখ সুবিধার দিকে খেয়াল রাখাই ছিল তাঁর স্বভাব। তাই সেই সময়ে, ঠাকুর্দার হঠাৎ এরকম একটা অসুখ আর তাঁকে দেখাশোনা করতে গিয়ে ঠাকুমার হিমসিম অবস্থা দেখে, বাবা তক্ষুনি সন্তান হিসাবে তাঁর কর্তব্য ঠিক করে ফেললেন। চাকরি, গবেষণা বা নিজের ভবিষ্যৎ – কিছু না ভেবে দিনরাত, অক্লান্তভাবে, ঠাকুর্দার সেবায় মন দিলেন।

দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল। একদিন রাস্তায় বাবার সাথে, তাঁর ফেলে আসা কলেজ জীবনের, এক প্রিয় অধ্যাপকের সাথে দেখা। ডক্টরেট করার পরেও, তাঁর এই স্বল্পবাক, মৃদুভাষী মেধাবী ছাত্রটি এক বছর ধরে চাকরি বাকরি কোনো কিছু না করে বাড়িতেই রয়েছেন শুনে তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন। বাবার কোন ওজর আপত্তি না শুনে তখনি তাঁকে ধরে নিয়ে ঠাকুর্দার সিমলে স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন। ঠাকুর্দা, ঠাকুমাকে বুঝিয়ে, বাড়ির অন্য সকলের সাথে কথা বলে তিনি ঠাকুর্দাকে দেখাশোনা করবার অন্য একটি কার্যকরী বিকল্প ব্যবস্থা ঠিক করলেন। এমনকি কথাও দিলেন উনি নিজেই বাবার জন্য উপযুক্ত কাজের সন্ধান করবেন। তবে শর্ত হল, চাকরির ডাক যদি আসে তখন কিন্তু আর কোনো রকম দ্বিধা করা চলবে না।

ঠাকুর্দা, ঠাকুমা এবং অবশ্যই বাবা, সেই শর্তে রাজি হলেন। ক’দিনের মধ্যেই বাবার ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পড়লো বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এক স্কটিশ সাহেবের কাছে। সেইদিনই সেইখানেই বাবাকে মংপুর কুইনিন ফ্যাক্টরি ও রিসার্চ সেন্টারের অধ্যক্ষ হিসাবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গিয়ে যোগ দিতে বলা হল। সেই সময় মংপুর কুইনিন প্লান্টেশন প্রোডাকশন ও রিসার্চ সেন্টার বোটানিক্যাল গার্ডেনের আওতায় ছিলো।

মংপু তখন এক অখ্যাত জায়গা, কেউই তার নাম শোনেননি। এমনকি ম্যাপেও তার হদিস পাওয়া গেল না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনেকেই বোঝালেন এমন জঙ্গলে চাকরি নেবার দরকারটা কি? বিদেশে বিভূঁইয়ে বেঘোরে যদি প্রাণটা যায় তাহলে তো চাকরিটিও তার সাথে সাথে যাবে, তাই না? অকাট্য যুক্তি বটে, কিন্তু বাবা তো তাঁর অধ্যাপককে কথা দিয়েছেন যে চাকরি পেলে আর এদিক ওদিক করবেন না। তাই দুদিনের মধ্যে তৈরি হয়ে মা বাবার আশীর্বাদ নিয়ে, বেশ একটু যেন চিন্তাচ্ছন্ন মন নিয়েই বাবা তার ভবিষ্যৎ চাকুরিক্ষেত্র মংপুর দিকে রওনা দিলেন। যাত্রার প্রথম পর্বে বাক্সপত্র সমেত নির্বিঘ্নে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছলেন।

শুরু হল যাত্রার দ্বিতীয় পর্ব।

মংপুর পথে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলের সাহেবি কেতার ঝকমকে কামরায় বাবা উঠে বসলেন। বাবার এই প্রথম হিমালয় দর্শন। বাবাকে নিয়ে ট্রেন ধীরে ধীরে স্টেশন ছাড়ল।

দেখতে দেখতে সমতল পিছনে ফেলে পাহাড়ের গায়ে প্রায় খাঁজ কেটে বসানো রেল লাইন ধরে ট্রেন হাঁপাতে হাঁপাতে হিমালয়ের গভীরে উঠতে লাগল। পিছনে পড়ে রইল শ্যামবাজারের হট্টগোল, কলেজ স্ট্রিটের ট্রামের ঘন্টা আর উত্তর কলকাতার আবাল্য পরিচিত সিমলে স্ট্রিটের পাড়া। বহু দূরে সরে গেল কৃত্রিম শহুরে জনারণ্য, বাবা এসে পড়লেন এক আদিম পৃথিবীর রহস্যাবৃত নিবিড় সবুজ অরণ্যের স্বপ্ন রাজ্যে। ট্রেন যতই এগোতে লাগল অনাস্বাদিতপূর্ব এক শীতল স্নিগ্ধ বাতাসের ছোঁয়ায় তাঁর শরীর মনে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রাচীন পাহাড়ের একেবারে কোল ঘেঁষে চলেছে ট্রেন। পাথরের গা আঁকড়ে রয়েছে নানা জাতের, নানা রূপের হিমালয়ান মস, জংলা সবুজ ঘাসের ভিড়। তারি মাঝে মাঝে জায়গা করে দুলে দুলে হাসছে ছোট ছোট বুনো ফুলের দল।

ছবি – লেখক

মংপুর এই চিরকালীন অপূর্ব সৌন্দর্যের অপূর্ব বর্ণনা করে গেছেন বিশ্ব কবি তাঁর মংপু কবিতায়।

“বহু কেলে জাদুকর, খেলা বহু দিন তার,
আর কোনো দায় নেই,লেশ নেই চিন্তার।
দূর বৎসর পানে ধ্যানে চাই যদ্দুর
দেখি লুকোচুরি খেলে মেঘ আর রোদ্দুর ।”

বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী, অনন্তকাল ধরে এই সব গাছপালা লতাপাতা ঘাস গুল্ম সাদরে সযত্নে নিষ্প্রাণ পাথর গুলোকে সজীব, সপ্রেম আলিঙ্গনে আঁকড়ে ধরে সবুজের স্নিগ্ধ আস্তরণে কঠিন কঠোর কে প্রাণের স্নেহ দিয়ে ঢেকে রেখেছে। নীচে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে তিস্তা, যেন সুদূরের কোনো অদৃশ্য সমুদ্রের সস্নেহ আদিম আহ্বান সে শুনতে পেয়েছে। আর কোনো বাঁধা সে মানবেনা। বড় বড় পাথর তার পথ আগলাতে গিয়ে, এধারে ওধারে পরাজিত মল্লবীরের মতো উল্টে পাল্টে পড়ে আছে। আর ওপারের সবুজ যেন জন্মজন্মান্তরের তৃষ্ণা নিয়ে নেমে এসেছে জলের কিনারায়। শীতের সময় নদীর মরা বুক চিরে মাঝে মাঝে বেরিয়ে এসেছে ছোট বড় পাথুরে সব চর।

তবে বর্ষা এলে এইসব চরের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। তার মরা বুকের সব ক্ষত, সব দৈন্য ঢেকে বানভাসি হবে নদী। শীতের নদীর মনভোলানো গুঞ্জন তখন গভীর গর্জন হয়ে উঠবে। তখন কার সাহস তার কাছে যায়। ওপারে খাড়াই ভরাট পাহাড়, ঘন জঙ্গল। বিশাল দীর্ঘ ঋজু আদিম গাছগুলো সব প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে- ওদের কাছে নিজেকে যেন বড়ই ক্ষুদ্র, বড়ই অসহায় মনে হয়। মাঝে মাঝে অ্যালোপেসিয়ার রোগের মতো পাহাড়ের ধ্বস নামা নেড়া খাপছাড়া জায়গাগুলো জেগে আছে – সেখানে সবুজ তার আসর জমাতে পারে নি। বিধ্বংসী ধ্বসের ইতিকথা পাহাড়ের বুকে যেন খোদাই করে রাখা হয়েছে। প্রকৃতির এই উদাত্ত রূপ ক্রমশ বাবার শহুরে মনকে মোহাবিষ্ট করে তুলছিল। দুপুরের কাছাকাছি মংপু পাহাড়ের পায়ের কাছে একটা ছোট্ট খেলনার স্টেশন- “রম্বি” তে খেলনার ট্রেনটি ধূম্রজালে চতুর্দিক আচ্ছন্ন করে এসে দাঁড়ালো।

মংপু যেতে হলে এইখানেই নামতে হত তখন। তারপর বাবাকে সেখানে নামিয়ে দিয়েই ঊর্ধ্বশ্বাসে ঊর্ধ্বপানে রওনা দিলে সে….তাকে যেতে হবে আরো অনেক দূরে…..আরো প্রায় সাত হাজার ফুট উপরে – তার গন্তব্যস্থল পাহাড়ের রানী দার্জিলিং স্টেশনের দিকে।

বাঙালি স্টেশন মাস্টার মশাই প্লাটফর্মেই অপেক্ষা করছিলেন। বাবাকে নিয়ে সেই ছোট্ট স্টেশনের ছোট্ট আপিস ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন ‘আমি তো সকালেই আপনার অফিসের টেলিগ্রাম পেয়েছি। আপনি আসছেন, মংপু যাবেন। সব জানি। আপনাকে নিয়ে যাবার যানবাহনও এসে গেছে। অনেকটাই লম্বা রাস্তা.. আপনি আগে একটু বসুন, বিশ্রাম নিন ….. এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা তো করি। চা খেয়েই যাত্রা শুরু করবেন এখন’। তখনকার দিনে দার্জিলিংয়ের চায়ের সৌরভ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর সেই সৌরভ ছিল বাঙালির গৌরব। আজও “সৌরভ” বাঙলার গৌরব তবে সে চায়ের জন্য নয়, অন্য কারণে। শীতের দিনে স্টেশন মাস্টারমশাইয়ের এই প্রস্তাব বাবার মন্দ লাগলো না। চায়ের পর্ব শেষ হতে না হতেই স্টেশন মাস্টার মশাই জানলা দিয়ে একবার উঁকি দিয়ে বেশ একটু ব্যস্তসমস্ত হয়েই যেন বললেন – ‘আপনার কাছে কলকাতার গল্প আরো একটু শোনবার ইচ্ছে ছিল মশাই কিন্তু সে উপায় নেই….সামনে এখনো অনেকটা পথ অন্ধকার হবার আগেই আপনার মংপু পৌঁছানো দরকার। আপনাকে আর দেরি করানো যাবে না। এদিকে আবার হিমালয়ের ভাল্লুক আর চিতার উপদ্রবটাও আজকাল বেশ বেড়েছে শুনছি। এইতো সেদিন – একটা নয়/দশ বছরের ছেলেকে টেনে নিয়ে গেছে। বড়ই দুঃখের ঘটনা’। মংপু যাত্রার পথের পাথেয় হিসেবে তিনি এই ঘটনার রোমহর্ষক বিবরণ দিলেন। বাবা যাত্রার জন্য উঠে দাঁড়ালে, স্টেশন মাস্টার মশাই নমস্কার করে বললেন ‘আমি আর আপনার সাথে এগিয়ে দিতে আসছি না, ডাউন ট্রেনের সময় হয়ে এসেছে। আমাকে আবার প্লাটফর্মে ছুটতে হবে। তবে আপনার কোন চিন্তা নেই। আপনার জিনিসপত্তর আর আপনার যানবাহন সব রাস্তায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’

বাইরে এসে বাবা দেখেন “বাহন”টি হল পাক্কা ওয়ান হর্স-পাওয়ারের একটি প্রায় সাড়ে পাঁচফুট উঁচু তরতাজা অস্ট্রেলিয়ান ঘোড়া আর সহিসটি হলেন তার সঙ্গী। অনেক অফিসেই কনভেয়েন্স দেয় শুনেছেন বাবা, কিন্তু কনভেয়েন্সের চেহারা দেখে বাবার তো চক্ষুস্থির। প্রায় “জান” চলে যাবার অবস্থা। বাবা জীবনে কখনো ঘোড়ায় চড়েন নি। ঘোড়া সম্বন্ধে তাঁর যত জ্ঞান তা মোটামুটি বইয়ের মলাটের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তার উপরে সহিসটি ভাঙা ভাঙা হিন্দি, দুর্বোধ্য নেপালি আর আকারে ইঙ্গিতে যা বোঝালে সাদা বাংলায় তার অর্থ হল বাবাকে নাকি এখন একা একা এই অচেনা অদেখা এক গহীন বনের আলো অন্ধকারের মধ্যে আবছা হয়ে আসা পায়ে চলা সঙ্কীর্ণ, পিচ্ছিল, ঊর্ধ্বমুখী পাহাড়ি সুঁড়ি পথ ধরে এই অশ্ব সহায় করে প্রায় সাড়ে চার হাজার ফিট উপরে মংপু পৌঁছাতে হবে। সঙ্গী সহিসটি বাবার জিনিস পত্র তার পিঠের ঝুড়িতে নিয়ে পিছন পিছন আসবে – তবে সে যে কত পিছনে আসবে এবং কখন আসবে তার কোনো ঠিক নেই, অতএব এমন সঙ্গীর সঙ্গর ওপর বিশেষ ভরসার কিছু কারণ নেই। বলে রাখা ভাল এই সময় পাহাড়ে ওঠার সেই রকম কিছু ব্যবস্থা না থাকায় নেপালি কুলিরা তাদের পিঠের ঝুড়িতে করে মাল পত্র নিয়ে পাহাড়ে ওঠা নামা করতো। ভার নিয়ে পাহাড়ে চড়া সে বড় কঠিন কাজ। বাবা তো তাঁর মংপু পৌঁছানোর কনভেয়েন্সের এই রোমহর্ষক ব্যবস্থা শুনে এবং দেখে হতভম্ব ও হতবাক। কলকাতার নিশ্চিন্ত, নিরুপদ্রব এক জীবন যাত্রার ছবি এক মুহূর্তের জন্য উঁকি দিল তার মনে। যখন আবার কথা বলতে পারলেন সহিসটি কে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করলেন যে ব্যবস্থাটা তো খুবই ভালো কিন্তু একটা ছোট্ট সমস্যা হচ্ছে তিনি তো রাস্তাই চেনেন না তাছাড়া ঘোড়াও তো কখনো চড়েন নি। সহিসটি তখন তার সেই হিন্দি আর নেপালি ভাষার অদ্ভুত সংমিশ্রণে এবং আকারে ইঙ্গিতে বাবাকে আবার আশ্বস্ত করে বললে যে কোন চিন্তা নেই কারণ ঘোড়ার জি.পি.এস সিস্টেম খুব ভালো, ঘোড়া ঠিক রাস্তা চিনে পৌঁছে যাবে – এই নিয়ে সাহেবের কোনো রকম ভাবনা করতে হবে না। এবং বাবাকে টেনে টুনে ঠেলে ঠুলে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে দেওয়া হবে….বাবার একমাত্র কাজ হোল এরপর ওই উচ্চাসন থেকে কোনো ভাবেই বিচ্যুত না হওয়া এমনকি কোন বুনো জন্তুর সঙ্গে দেখা হলেও নয়। ঘোড়াই যা করবার তা করবে। বাবাকে শুধু কোনো রকমে মংপু পর্যন্ত ঘোড়াটির পিঠে টিকে থাকতে হবে। সেই দিনটি ছিল বাবার জীবনের এক সন্ধিক্ষণ।

বাবা তার নিজের ধৈর্য ও সাহস এবং ঘোড়ার হর্স সেন্সের উপর ভরসা করে কাজে যোগ দেওয়ার এই অসাধারণ পথের শেষ রোমহর্ষক পর্ব পার করার জন্য মাটির পরিচিত আশ্রয় ছেড়ে ঘোড়ার পিঠের অনিশ্চয়তার ওপর নিজেকে সমর্পণ করলেন।উপায় নেই প্রফেসর কে কথা দিয়েছেন। তাছাড়া বোটানিক্যাল গার্ডেনের সাহেবের কাছে বাঙালীর সম্মান রক্ষা করতে হবে। শুরু হলো বাবার মংপু যাত্রার শেষ ও তৃতীয় পর্ব।

১৯৪০ সালে তোলা মংপুর বাংলোয় যাওয়ার রাস্তার আলোকচিত্র  ছবি – লেখক

দেখতে দেখতে ছোট্ট ছবির মতো লোকালয় রম্বি পিছনে হারিয়ে গেল। নিবিড় কুমারী অরণ্যের গভীর গম্ভীর নিস্তব্ধতা ধীরে ধীরে বাবার মনকে মোহাচ্ছন্ন করে তুলতে লাগল। প্রতি পদক্ষেপে হারিয়ে যেতে লাগল চিরপরিচিত সিমলে স্ট্রিট, চিরপরিচিত নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রার ছবি। মাথার অনেক উপর প্রাচীন সব আকাশচুম্বী গাছগুলির ডাল পালা স্নেহভরে জড়াজড়ি করে এক পান্না সবুজ চন্দ্রাতপ রচনা করে রেখেছে। সেই সস্নেহ আচ্ছাদনের নিচে দিয়ে এক ছায়াময় নিভৃত, সুগহন প্রকৃতির বিচিত্র বিরাট রূপের আস্বাদন করতে লাগলেন। সেদিন সেই এক দেড় ঘন্টার যাত্রায়, অরণ্যের পাঠশালায় বাবা যে শিক্ষা লাভ করেছিলেন তা বোধহয় ডক্টরেট পাওয়ার চাইতে কিছু কম নয়। শহুরে পরিবেশ থেকে বেরিয়েই কয়েক ঘন্টার মধ্যে ঘোড়ার পিঠে চড়ে গভীর অরণ্যের ভিতর দিয়ে দীর্ঘ পথ পার হয়ে বাবা যে আশ্চর্য সাহস ও চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে ছিলেন তা আমাদের কাছে চিরকাল শিক্ষা এবং গৌরবের ব্যাপার হয়ে রয়ে গেছে। সেই দিন ঐ দুর্গম পথ অতিক্রম করে বাবা যে চাকরিতে যোগ দিতে পেরেছিলেন তার জন্যই মংপুর নাম আজ ঘরে ঘরে এমনকি দেশে বিদেশে ছড়িয়ে গেছে।

মংপুর আউটহাউস। ছবি – লেখক

ঠিক দশ বছর পর, মংপু যাবার কাঁচা, এবড়ো খেবড়ো কিন্তু গাড়ী চলার মতো গ্রামের পথ ধরে এক বিশ্বপথিক, আমাদের সকলের প্রাণপ্রিয় বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার মা বাবার আমন্ত্রণে চার বার মংপুতে এসে মংপুকে একটি তীর্থস্থানের আসনে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।

মংপুতে একটি সকাল –     ছবি – লেখক

শৈশবকাল থেকেই রাবীন্দ্রিক আবহাওয়ায় বড় হয়ে উঠেছিলেন আমার মা। বাড়ীতে নিরন্তর তাঁর একনিষ্ঠ রবীন্দ্রানুরাগী মা, বাবার রবীন্দ্রকবিতা,সাহিত্য পাঠ আলোচনা শুনে শুনেই তাঁর বেড়ে ওঠা। ছোট থেকেই তাঁর জীবন ছিল রবীন্দ্র ভাবনা ও রবীন্দ্র জীবনাদর্শে সংপৃক্ত। বাবার হাত ধরে অতি অল্প বয়সে রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর প্রথম যাওয়া। আমার দাদু সুখ্যাত দার্শনিক শ্রী সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন কবিগুরুর বিশেষ স্নেহধন্য ভক্ত ও বন্ধু। দাদু নানা বিষয়ে আলোচনা, উপদেশের জন্যে সুযোগ পেলেই রবীন্দ্রনাথের কাছে উপস্থিত হতেন। আর বেশির ভাগ সময়ই দাদুর এই রবীন্দ্র সন্দর্শন যাত্রা গুলিতে সঙ্গ নিতেন আমার মা। সেই ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান কবিতা লেখা ও তাঁর স্নেহের সান্নিধ্যে তিনি ধীরে ধীরে কবিগুরুর মানস কন্যা হয়ে উঠেছিলেন। অনাবিল শ্রদ্ধা ও ভক্তির যে অপরূপ হৃদয়অর্ঘ্য আমার মা সাজিয়েছিলেন, তার সুবাস তাঁর গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তর স্পর্শ করেছিল। তাই বিয়ের পরে মা যখন সুদূর শৈলরাজ হিমালয়ের কোলে অরণ্যবেষ্টিত নির্জন মংপু তে এসে তাঁর নতুন সংসার পাতলেন তখন মা বাবার মিলিত অনুরোধে কবিগুরু প্রায় আশি বছরের অসুস্থ শরীরে বিপদ সঙ্কুল পাহাড়ি পথে মংপুর মত এক অচেনা অজানা পাহাড়ি বসতিতে আমার মা বাবার সযত্নে লালিত লক্ষ্মীর সংসারে আসতে রাজি হয়ে আমাদের পরিবারকে চির জীবনের জন্য ঐশ্বর্যবান করেছিলেন।

মংপুর বড়ির বারান্দার এক কোণের কাঁচের এই ছোট ঘরটি কবির প্রিয় কর্মস্থান হয়ে ওঠে। এই ঘরে বসলে দিগন্ত বিস্তৃত দূরের পাহাড় ও প্রকৃতিকে কাছে পাওয়া যেত। যখন মংপুতে থাকতেন তখন এই ঘরে বসে অনেক লেখা ও আঁকার কাজ করে গেছেন।      ছবি – লেখক

কাজে যোগ দেবার পরে আমার বাবা আরো প্রায় পঁচিশ বছর মংপুতে ছিলেন। আর সেই ঘোড়াটি বাবার কাছেই বাবার প্লান্টেশন পরিদর্শনের কাজের একমাত্র বাহন হয়ে তার বাকি জীবনটা কাটায়। বাবা তাঁর দীর্ঘ কর্ম জীবনে মারাত্মক ম্যালেরিয়া রোগের তখনকার দিনের একমাত্র প্রতিষেধক মৃত্যুঞ্জয় কুইনিনের প্রস্তুতি ও উন্নতির কাজে নিযুক্ত ছিলেন। মংপুও এই প্রাণদায়ী কর্মযজ্ঞে পৃথিবীর এক অন্যতম প্রধান কর্মক্ষেত্র হয়ে ওঠে।

মংপুর এই কুইনিন দেশে বিদেশে লক্ষ লক্ষ মুমূর্ষু মানুষ কে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরিয়ে আনে। কুইনিন তখন ছিলো এই মৃত্যুদূত ম্যালেরিয়ার একমাত্র রক্ষাকবচ। আর এই কুইনিন এর প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত হবার পরেই মংপু মানুষের মনের মানচিত্রে একটা স্থান পাবার পথে পদক্ষেপ করেছিল। এই কুইনিনের কিন্তু মংপুতে জন্ম হয়নি, পৃথিবীর আরেক প্রান্তে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে, আরেক বিখ্যাত পর্বত মালা পেরুর এন্ডিসের কোলে তার আদি জন্মস্থান, ১৬২৯ সালে। তার সম্পর্কে পরিশিষ্টে কিছু কথা রইল আগ্রহী পাঠকের জন্য।

১৬২৯ সালে পেরুতে কাউন্টেসের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসার ঠিক তিনশ বছর পর ১৯২৯ সালে বাবা মংপুতে কুইনিন ফ্যাক্টরি ও তার পরে দার্জিলিং ডিস্ট্রিক্ট এর সবকটি সিনকোনা প্লান্টেশনের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন ও ১৯৫০ এর মাঝামাঝি অবসর নেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্নেহ ধন্যা ভক্ত আমার মা মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে মংপুতে এসে আমার মা বাবা, আমাদের পরিবার ও মংপুবাসী সকলের জীবন তাঁর ব্যক্তিত্বের আশ্চর্য আলোয় আলোকিত করে, উদ্ভাসিত করে, মংপুকে চিরকালের মত বিশ্বের দরবারে স্থান করে দিয়ে গেছেন।

মংপুর বাডির বাগানে তোলা ছবি। ছবিতে রয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমার বাবা মনমোহন সেন, মা মৈত্রেয়ী দেবী এবং মার মাসী সুব্রতা দেবী। ছবি – লেখক

তবে এ সব কাহিনীর অনেক আগে, মানুষের ইতিহাসের পাতা খোলারও বহু যুগ আগে থেকেই মংপু তার নৈসর্গিক রূপ নিয়ে কোন এক মহামানবের পায়ের ধ্বনি শোনার জন্যই যেন কান পেতে ছিল।

আর সেই মহামানব আমাদের বিশ্বকবির লেখায় মংপুর সেই যুগ যুগান্তরের মনোমুগ্ধকর রূপের নিম্নোক্ত বর্ণনাটিই মংপুর চিরস্থায়ী স্বরূপ।

“কুজ্ঝটি জাল যেই সরে গেল মংপুর
নীল শৈলের গায়ে দেখা দিল রংপুর।
বহুকেলে যাদুকর, খেলা বহু দিন তার,
আর কোন দায় নেই, লেশ নেই চিন্তার,
দূর বৎসর পানে ধ্যানে চাই যদ্দূর
দেখি লুকোচুরি খেলে মেঘ আর রোদ্দুর।
কত রাজা এলো গেল মোলো এরই মধ্যে,
লড়েছিল বীর, কবি লিখেছিল পদ্যে।
কত মাথা কাটাকাটি সভ্যে অসভ্যে_
কত মাথা ফাটাফাটি সনাতনে নব্যে।
ওই গাছ চির দিন যেন শিশু মস্ত
সূর্য উদয় দেখে দেখে তার অস্ত।
ওই ঢালু গিরিমালা রুক্ষ ও বন্ধ্যা
দিন গেলে ওরই পরে জপ করে সন্ধ্যা।
নিচে রেখা দেখা যায় ওই নদী তিস্তার
নিঠুরের স্বপ্নে ও মধুরের বিস্তার।
হেনকালে একদিন বৈশাখী গ্রীষ্মে
টানা পাখা চলা সেই সেকালের বিশ্বে,
রবি ঠাকুরের দেখা সেই দিন মাত্তর
আজ তো বয়স তার কেবল আটাত্তর।
সাতের পিঠের কাছে এক খানি শূন্য
শত শত বছরের ওদের তারুণ্য।
ছোট আয়ু মানুষের তবু একি কাণ্ড
এটুকু সীমায় গড়া মন ব্রহ্মাণ্ড।
কত সুখে দুখে গড়া ইষ্টে অনিষ্টে
সুন্দরে কুৎসিতে তিক্তে ও মিষ্টে,
কত গৃহ উৎসবে কত সভা সজ্জায়,
কত রসে মজ্জিত অস্থি ও মজ্জায়।
ভাষার নাগাল ছাড়া কত উপলব্ধি
ধেয়ানের মন্দিরে আছে তারা স্তব্ধি।
অবশেষে এক দিন বন্ধন খণ্ডি
অজানা অদৃষ্টের অদৃশ্য গণ্ডি
অন্তিম নিমেষেই হবে উত্তীর্ণ।
তখনি অকস্মাৎ হবে বিদীর্ণ
এত রেখা এত রঙে গড়া এই সৃষ্টি
এত মধু অঞ্জনে রঞ্জিত দৃষ্টি।
বিধাতা আপন ক্ষতি করে যদি ধার্য
নিজেরই তবিল ভাঙা হয় তার কার্য।
নিমেষেই নি:শেষ করি ভরা পাত্র
বেদনা না যদি তার লাগে কিছু মাত্র
আমারই কি লোকসান হই যদি শূন্য
শেষ ক্ষয় হলে তারে কে করিবে ক্ষুণ্ণ।
এ জীবনে পাওয়াটারই সীমাহীন মূল্য
মরণে হারানোটা তো নহে তার তুল্য।
রবিঠাকুরের পালা শেষ হবে সদ্য
তখনো তো হেথা এই অখণ্ড অদ্য
জাগ্রত রবে চির দিবসের জন্য।
এই গিরিতটে এই নীলিম অরণ্যে
তখনো চলিবে খেলা নেই যার যুক্তি
বারবার ঢাকা দেওয়া বার বার মুক্তি।
তখনও এ বিধাতার সুন্দর ভ্রান্তি
উদাসীন এ আকাশে এ মোহন কান্তি।”

মংপুর রঙ্গমঞ্চ থেকে সেদিনের এই সব অভিনেতা অভিনেত্রীরা কালের নিয়মে সসম্মানে বিদায় নিয়েছেন।

কিন্তু আজও মংপু তার নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে রেখেছে, যেখানে বিধাতার ইশারায় আজও মেঘ আর রোদ্দুরের সেই চিরকালীন লুকোচুরি খেলা চলেছে।

মংপুর সেই বাড়ি এখন একটি তীর্থস্থল, রবীন্দ্র-অনুরাগীদের কাছে।
ছবি – লেখক

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

1। গুগল
2। আমার বন্ধু শ্রী সুজন দাশগুপ্ত যার উৎসাহ ও উপদেশ ছাড়া এ লেখা জন্ম নিত না। সে আমার পলায়ন প্রবণতা জানে বলে, লেখা চলাকালে শক্ত হাতে লাগাম ধরে রেখে ছিল।
3. রূপা আমার স্ত্রী ও অভিভাবক যার সাহায্যে ও পরিশোধনে লেখটি পরিশোধিত হয়ে সমাজে মুখ দেখাবার সাহস পেয়েছে।

পরিশিষ্ট –

পেরুর সেই সিনকোনার গাছ ও কুইনিন সম্বন্ধে বেশ কিছু কিংবদন্তি প্রচলিত আছে— তার কোনটা সত্য কোনটা বা নিছকই কল্পনাপ্রসূত তা আজ বলা বড় শক্ত। তবে এই সব গল্পের সমন্বয়েই জন্ম আধুনিক কুইনিনের আর কুইনিন প্রস্তুতির এক কর্মক্ষেত্র হিসাবে পরিচিতি আজকের মংপুর।
এই সব প্রচলিত, বিক্ষিপ্ত গল্প গুলির মধ্যে যেটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং রোম্যান্টিক রূপকথা বলে মনে হয়েছে সেটিই প্রথমে এখানে লিখছি।

1700 খৃস্টাব্দের শুরুর দিকে স্পেনের মাদ্রিদ শহরের দক্ষিণে অবস্থিত, চিনকন কাউনটি বা প্রদেশের কাউণ্ট লুইস গেরোনিমো (জেরোনিমো) ডি ক্যাবরেরা দক্ষিণ আমেরিকার স্পেনের উপনিবেশ পেরুর ভাইসরয় নিযুক্ত হয়েছিলেন। পেরু জয় করে, লুটতরাজ করে, আর তার সোনা রূপোর খনি খনন করে স্প্যানিশরা তখন বিশ্বের সবচেয়ে স্পর্ধিত ধনী জাতি, কাউণ্ট সেই পেরুর স্প্যানিশ রাজ সমাজের চূড়ামণি। সে সময় দেশের রাজধানী লিমা শহরে কাউন্টের অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রী এনা ডি অসমিও পারিষদদের নিয়ে নাচ গান ভোজে স্ফূর্তিতে জীবন যাপন করছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই ঝলমলে সুন্দর দিন গুলির ওপর অতর্কিতেই এক কালো যবনিকা নেমে এল। জীবনের সব উচ্ছলতা, সব আলোই যেন নিমেষে ফুৎকারে নিভে গেল। হঠাৎ করেই কাউন্টেসের ভীষণ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে লাগল। জ্বর কমলে বেশ ঝরঝরে লাগে কিন্তু ফিরে ফিরে এসে সেই জ্বর তাঁকে ক্রমশ বিধ্বস্ত করে ফেলল।

বড় বড় স্প্যানিশ ডাক্তাররা হাজারো চেষ্টা করেও কাউন্টেসের জ্বর সারাতে না পেরে হার মানলেন। পরাস্ত হয়ে মাথা হেঁট করে সরে দাঁড়ালেন তাঁরা। কাউণ্ট অসহায় হয়ে দেখতে লাগলেন চোখের সামনে তাঁর অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রী দিনে দিনে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন। একটি কাহিনীতে বলা হয় যে কাউন্টেসের এক দেশীয় পরিচারিকা, রোজা, একদিন ভয়ে ভয়ে অসুস্থ কাউন্টেসকে বললে, – ‘গিন্নি-মা, আপনার যে জ্বর হচ্ছে তা আমাদের মধ্যেও হয় কিন্তু আমাদের কাছে এর এক ওষুধ আছে। আমাদের জঙ্গলের মধ্যে কুইনা কুইনা বলে একটি গাছ আছে। আমাদের মধ্যে কারো জ্বর হলে আমরা সেই গাছের ছাল শুকিয়ে গুঁড়ো করে খেয়ে দেখেছি যে তাতে এই জ্বর সেরে যায়। তবে আপনাকে তো বড়ো বড়ো ডাক্তাররা দেখছেন আপনি কি আর আমাদের ওষুধ খাবেন?’

কাউন্টেসের তখন বাছ বিচার করার অবস্থা নয়। তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে পরিচারিকাটিকে বললেন সেই গাছের ছাল এনে দিতে। আর সত্যি সত্যিই, দু তিন দিন সেই ভীষণ তিতো গাছের ছালের গুঁড়ো খেতে না খেতেই কাউন্টেসের জ্বর সম্পূর্ণ সেরে গেল। কাউণ্ট ও তাঁর নাম করা ডাক্তাররা কাউন্টেসের এই অভাবনীয় রোগমুক্তিতে তো উল্লসিত বটেই কিন্তু সেইসঙ্গে কিছুটা হতবাক ও কিছুটা বিভ্রান্তও।
বিচিত্র মানুষের চরিত্র। কৃতজ্ঞ হওয়ার বদলে অহংকারী সেই কাউন্ট ওই সরল সাদা সিধা পরোপকারী পরিচারিকাটির মৃত্যুদণ্ড দেন। তার অপরাধ কাউন্টের বিনা অনুমতিতে দেশীয় অশিক্ষিত মানুষদের ব্যবহৃত বন্য গাছপালার ওষুধ তাঁর স্ত্রীকে খাওয়ানোর সে স্পর্ধা করেছিল। পৃথিবীতে কে যে শিক্ষিত আর কে যে অশিক্ষিত তা বোঝা বড় শক্ত।

কর্ম জীবনের শেষে কাউন্টরা যখন স্পেনে ফিরেছিলেন তখন কিন্তু পেরুর অরণ্যের সেই প্রাণদায়ী গাছের ছাল পর্যাপ্ত পরিমাণে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। দেশে ফিরে দেশের মানুষদের এই জ্বর সারাতে কাউন্টেস গাছের ছালের ওষধি বিনা পয়সায় বিলি করেন। এই কারণে কাউন্টেসের প্রচুর সুনাম হয় এবং তাই তাঁরই স্মরণে ঐ গাছটির নাম হয় সিনকোনা। অনুমান করা যায় দক্ষিণ আমেরিকার সেই ‘কুয়েচিও’ জাতির নিজেদের জ্বরজারি সারানোর কাজে বহুল ব্যবহৃত “কুইনা কুইনা গাছের থেকেই বোধ হয় ম্যালেরিয়া প্রতিষেধকের নাম “কুইনিন” হয়ে থাকবে।

আরেকটি কাহিনীতে বলা হয় এন্ডিস পাহাড়ি অঞ্চলে কুইনা কুইনা গাছের প্রাচুর্য ছিল। সেখানকার স্প্যানিশ ম্যাজিস্ট্রেট কাউন্টেসের অসুস্থতার কথা শুনে ওই ওষুধের খবর দিয়ে চিঠি দেন, আর তার পর সময় নষ্ট না করে চিঠির প্রায় সাথে সাথেই গাছের ছাল নিয়ে লিমায় চলে আসেন। তাঁর তৎপরতার জন্য কাউন্টেসের প্রাণ রক্ষা হয়। কৃতজ্ঞ কাউন্টেস লিমার রোগাক্রান্তদের জন্যে প্রচুর পরিমাণে এই গাছের ছাল আনিয়ে নিজ হাতে বিতরণ করেন। পেরুর পর্ব শেষ করে যখন শেষ বারের মত তিনি তাঁর নিজের দেশ স্পেনে ফিরে আসেন তখনো তিনি অপর্যাপ্ত পরিমাণে এই গাছের ছাল সঙ্গে এনে এই জ্বরের হাত থেকে বহু রোগাক্রান্ত দেশবাসীর জীবন রক্ষা করেন ও ইউরোপে এই অমূল্য সম্পদের কথা প্রথম প্রচার করেন। অনেক পরে ক্লেমেন্ট মার্কন ব্রিটিশ রয়াল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হবার পর কাউন্টেসের কাহিনীর বহুল প্রচার হয়।

অনেকের ধারণা এ সবই মানুষের কল্পনা প্রসূত গুজব বা অর্ধ সত্য কাহিনি।এবং আসলে জেসুইট পাদ্রীরাই আদিবাসীদের কাছ থেকে এই অমূল্য গাছের ছালের উপকারিতা জেনে ইউরোপে এর প্রচলন করেন।
তবে সত্য যাই হোক, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, যে, ম্যালেরিয়ার হাত থেকে মুক্তির জন্য সমস্ত মানবজাতি পেরুর এই ‘কুয়েচিও’ দের কাছেই আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।

সিঙ্কোনা প্ল্যান্টেশন। ছবি – দার্জিলিং ট্যুরিজম

এই সিনকোনা প্রসূত ওষুধ কুইনিনের ব্যবহার প্রচলিত না হলে যে আমাদের কি অবস্থা হত তা কয়েকটি ভয়াবহ “বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না” এমন কিছু পুরানো চিকিৎসা পদ্ধতির কথা শুনলেই বোঝা যায়। যেমন কিনা মাকড়সার জাল সুদ্ধু মাকড়সা সেবন, নানাভাবে রক্ত ক্ষরণ করানো। চেপে ধরে হাত বা পা কেটে বাদ দেওয়া। এই ধরনের আরো কিছু চমকপ্রদ এবং বীভৎস পুরানো ম্যালেরিয়ার দেশীবিদেশী চিকিৎসা পদ্ধতির কথা কাগজপত্র ঘাঁটলে পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলি এতই অবাস্তব যে এখানে উল্লেখ করার আর সাহস করলাম না।

ভাগ্য ভালো, কুইনিনের আবিষ্কারের ফলে আমরা শেষ পর্যন্ত এই সব আসুরিক ও ভয়ানক চিকিৎসার যুগ পেরিয়ে আসতে পেরেছি। তার পর থেকে কিন্তু এই কুইনিন দুমুখো তরবারির মত একদিকে যেমন পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে, অন্য দিকে তেমনি, সাম্রাজ্যবাদের সহায় হয়ে সহস্র লোকের প্রাণ ও স্বাধীনতার অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ রাজ্য বিস্তারে পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করেছে।

 

মৈত্রেয়ী দেবীর পুত্র প্রিয়দর্শী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরোবার পর তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর মায়ের জীবনের নানা সমাজ কল্যাণ মূলক কাজের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল দুস্থ ছেলেমেয়েদের জন্যে একটি আবাসিক অবৈতনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “খেলাঘর” এর সূচনা। 1971 সালে সৃষ্ট এই প্রতিষ্ঠানটির প্রসারণ, রক্ষা ও পরিচালনার কাজে বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে অঙ্গাঙ্গি ভাবে সস্ত্রীক জড়িত।

3 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Srabani Akilla , January 17, 2021 @ 5:01 am

    আহা কি অপূর্ব কিছু পড়লাম,জানলাম ! ধন্যবাদ

  • Sarmistha Mondal , June 8, 2021 @ 5:25 pm

    অসাধারণ। মন ভরে গেল। এত কিছু সবিস্তারে জানা ছিল না।
    খুব খুব খুব সুন্দর একটা উপস্হাপনা।🙏

  • চাষী সিরাজুল ইসলাম , September 6, 2021 @ 1:48 pm

    অপূর্ব ব্যক্তিগত গদ্য পড়লাম। মৈত্রীয় দেবীর ন হন্যতে পড়েছি। মংপুতে রবীন্দ্রনাথ পড়িনি। তার কিছুটা যেনো এ লেখায় পেলাম। অপূর্ব লেখনী এই গদ্য। মংপুতে রবীন্দ্রনাথ পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *